ভোরের আলো তখনও ঠিকমতো জেগে ওঠেনি। ৪ আগস্টের সকালটা ছিল যেন অদ্ভুত রকমের ভারী। কুড়িগ্রামের মেসে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আকাশটা কিছুটা মেঘলা, কিন্তু আমার বুকের ভেতর চলছিল ঝড়। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই মুখগুলো—যারা হারিয়ে গেছে, নিপীড়নের শিকার হয়েছে, অথচ বিচারহীনতায় চাপা পড়ে আছে।
আমি মোছাঃ স্বপ্না আক্তার। সেদিন আমি শুধু একজন ছাত্রী ছিলাম না—আমি ছিলাম প্রতিবাদের কণ্ঠ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক যোদ্ধা।
সকাল ১০টায় বড় আপুদের সঙ্গে মিছিলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি দাদা মোড় থেকে। কাঁধে ব্যাগ না, হাতে ছিল পোস্টার। কপালে বাঁধা ছিল বাংলাদেশের পতাকা। আমার গায়ে ছিল কালো বোরকা, সাদা এপ্রোন আর লাল হিজাব—রক্তের প্রতীক হয়ে যেন মাথার ওপর জ্বলছিল।
রাস্তায় একের পর এক কণ্ঠে উঠছিল স্লোগান—
"আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না!"
সেই স্লোগানে কাঁপছিল কুড়িগ্রামের বাতাস। আমার পেছনে সাত হাজার মানুষ, সব বয়সের, সব শ্রেণির। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম ছোট ছোট স্কুলপড়ুয়া ভাইবোনদের দেখে—ওদের চোখে ছিল ভয় নয়, ছিল আগুন।
আমার এক বন্ধু সেদিন সকালে প্রশ্ন করেছিল,
“স্বপ্না, যাবো তো আজ?”
আমি বলেছিলাম, “যদি জীবন দিতে পারো, তবে এসো।”
সে এসেছিল, আমরা ছিলাম পাঁচজন বন্ধু—একই স্বপ্ন নিয়ে পথে।
কিন্তু সবকিছু পালটে গেল যখন আমরা পৌঁছাই কুড়িগ্রাম শাপলা চত্বর কবরস্থান সংলগ্ন এলাকায়। হঠাৎ করে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। প্রতিবাদের ভাষায় আমরা ইট-পাটকেল ছুড়ি—আমাদের অস্ত্র, আমাদের রাগের প্রতিফলন। ঠিক তখনই ছাত্রলীগের কিছু সদস্য আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি লাঠির আঘাতে রাস্তায় পড়ে যাই, শরীর তখন আর চলছিল না।
ঘড়ির কাঁটা তখন ১১টা ৩৫ মিনিট। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমার কাপড়। তখন দুটি অপরিচিত হাত আমাকে তুলে নেয়। রিকশায় করে আমাকে নিয়ে যায় কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে। শরীর ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু মন? সে তখনও আগুনে জ্বলছিল।
আমি জানি না সেই দুজন কে ছিল, কিন্তু জানি—ওদের মতো ভালোবাসা, ওদের মতো সহমর্মিতা বাঁচিয়ে রাখে এই লড়াইকে।
---
আমি গর্বিত আমি গিয়েছিলাম।
আমি গর্বিত আমি প্রতিবাদ করেছিলাম।
আমি গর্বিত আমি একজন জূলাইয়ের যোদ্ধা।